স্বামী

স্বামী

স্বামী

সোহান রুমের চারিদিকে চোখ বুলাতে থাকে। বুকের ভেতরে কে যেনো হাতুরি দিয়ে দুম দুম করে বারি দিচ্ছে। 
সাথী সোহানকে বলল,
- ভাইয়া তুমি বিশ্রাম নাও আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। 
সাথী চলে গেলে সোহান বালিশে হেলান দিয়ে একাকীত্ব অনুভব করতে থাকে। আজ সোহানের সব থেকেও নিজেকে তার নিঃস্ব লাগছে। হয়তো এটাই তার প্রাপ্য ছিল। পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। জীবনে যে অন্যায় করেছে তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে। রুমের যেদিকে তাকাচ্ছে সব জায়গাতেই জান্নাতকে দেখতে পাচ্ছে। না এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কোন কিছুর সমাধান হবে না। জান্নাতের কাছে যেতে হবে। সাথী ঠিকি বলেছে আমার নিজের ভুলের জন্য জান্নাতের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। জান্নাতকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। 

সোহানের মা প্রচণ্ড রকমে রেগে আছে। মাথার একপাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে। ছেলের কৃতকর্মের কথা ভাবতে পারছে না। এই ছেলেকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছে কী কারণে সেটাই ভাবতে পারছে না। আদর দিয়ে মাথায় তুলে দেওয়ার কারণে এত বড় ঘটনা ঘটাতে পারল সোহান। নিজের স্ত্রীকে রেখে,, ছিঃ ছিঃ ভাবতেই পারছে না সে। আজ এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। 


সোহানের বাবার কাছে কীভাবে মুখ দেখাবে ভাবতেই বুকটা কষ্টে কেঁদে ওঠে। ছোট ছেলে সজল তার বউকে নিয়ে বিয়ের পর থেকেই আমেরিকাতে সেটেল হয়ে গেছে আদৌ দেশে আসবে কিনা সন্দেহ! বড় ছেলেটাকে নিয়ে এত গর্ব করেও কোন লাভ হয়নি। দিন শেষে ফলাফল শূণ্যের কোঠায়। এদিকে শুভ আসার কথা বলেও আসতে পারছে না বিভিন্ন সমস্যার কারণে। মেয়েটা আসার জন্য পাগলের মতো হয়ে আছে। কীভাবে ভাইয়ের এমন কথা ওর কাছে বলবে সেটা ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। 

মায়ের বাসায় চলে তো এসেছে জান্নাত। কিন্তু ওর ভরন পোষণের দ্বায়িত্ব কে নিবে? ওর পরিবার হয়তো কয়েকদিনের জন্য কিছু বলবে না কিন্তু একসময় তারা নিজেরাও বিরক্ত হয়ে যাবে। লোক কমানোর জন্যই তো তারা আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দিয়েছে। আজ না হয় কাল আবারও তারা তাদের আগের রুপে চলে আসবে। নিজের পড়াশুনাকে কন্টিনিউ করতে হবে কিন্তু কীভাবে? সমস্ত কাগজপত্র তো সোহানের মা তাদের ওদিকে নিয়ে গিয়েছে এখন কীভাবে কী সম্ভব কিছুই বুঝতে পারছে না। 
তাছাড়া বিবাহিত একটা মেয়ে সবার ঘরের কাটা হয়ে থাকে। কিছুদিনের জন্য আদর থাকলেও পরে সেটা বিষাক্তভাবে রুপ নেয়। 

- জান্নাত। 
মুখটা সামনের দিকে তাকিয়ে জি মা। 
- তুই ঠিকাছিস তো?
- ঠিক তো থাকতেই হবে মা। না থাকলে তো বাঁচতে পারব না। 
- খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে না রে। তোর এই অল্প বয়সে সবাই আনন্দ ফুর্তি করে ঘুরে বেড়ায় আর তোর জীবনটা এভাবে শেষ করে দিলাম। জানিস খুব কষ্ট পাচ্ছে তোর বাবা। মানুষটা এত ধৈর্য্যশীল ব্যক্তি যেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তোর কষ্ট তাকে ভেতরে ভেতরে কাঁদাচ্ছে কিন্তু সে তার বহিঃপ্রকাশ করছে না। তোর বাবার এই বিশেষ গুণটার জন্য তাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। 
- কী যে বলো না মা? আমি জানি বাবা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে তাই আমার জন্য তার সব সময় চিন্তা হয়। আমার নিজেরও খারাপ লাগে কিন্তু মা আমার যে হাত পা বন্দি তাই তো কিছু করতে পারছি না। এতদিন তোমাদের মাথার উপরে বোঝা ছিল না কিন্তু এখন আবার আমি এসে জুটলাম। 
- ধুর কীসব ফালতু কথা বলিস। তুই কী আমাদের পর নাকি! তুই শুধু খাবি আর ঘুমাবি। কোন ফালতু বিষয়ে চিন্তা করবি না। মানুষের জীবনে অনেক সময় কিছু অপূর্ণ চাহিদা থাকে যা সব সময় পূরণ হয় না। 
- মা আমাকে কয়েকটা টিউশনি জোগার করে দিবে। এভাবে ঘরে বসে সময় কাটবে না তাই বাচ্চাদের পড়ালে অভিশপ্ত দিনের কথা মনে পরবে না। 
- কী বলিস এসব? তোর বাবা কী তোকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াতে দিবে? 
- সেটা আমি বুঝব। বাবাকে কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেটা আমার ব্যাপার। 
- ঠিকাছে তোর ব্যাপার তুই বলিস আমি এসব বলতে পারব না। 
- মা, তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?
- কী করবি? 
- দরকার ছিল।
- কত টাকা? 
- তোমার কাছে কত আছে?
- এই ধর দেড় হাজারের মতো।
- আমাকে এক হাজার দিও তাইলে হবে। ধার হিসাবে নেব যখন আমার সময় হবে তখন ফেরত দিয়ে দিব। 
- জান্নাত কী শুরু করেছিস? আমি তোকে টাকা দিব সেটা আবার তুই ফেরত দিবি এটা কোন ধরণের কথাবার্তা। 
- মা তুমি আমাকে নিজে থেকে দিলে সেটা আলাদা কথা কিন্তু আমি তো ধার হিসাবে নিচ্ছি তাই ফেরত দিব। 
- কম কথা বলবি। 
- মা,,,, 
- চুপপ। তুই থাক আমি আসছি। 

একটুবাদে সখিনা বেগম এসে জান্নাতের হাতে টাকা দিয়ে বলল, মা রে এখানে দেড় হাজার টাকা আছে। তোর নিজের টাকা মনে করে খরচ করবি। খরচ করার সময় কোন কিছু ভাববি না। 
- মা পুরো টাকা দিয়ে দিলে তুমি কীভাবে চলবে? মাসের তো এখনো অনেকদিন বাকী!
- আমার কাছে লুকানো পাঁচশত টাকার মতো আছে তাই দিয়ে খরচ করব। তাছাড়া আমার আবার কীসের চাহিদা বল? তোর বাবা তো সব কিছু এনে দেয়। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে আমাকে কিছু টাকা দেয় হাত খরচের জন্য আমার তো আর হাত খরচ নেই তাই জমিয়ে রাখি যখন প্রয়োজন হয় খরচ করি। 
জান্নাত মাকে জড়িয়ে ধরল। 

আজ পুরো দশদিন হলো জান্নাতের সাথে সোহানের কোন যোগাযোগ নেই। জান্নাত আসার সময় মোবাইলটাও নিয়ে আসেনি। সোহান জান্নাতের বাবার ফোনে গতকাল রাতে কল দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। জান্নাতের বাবা বলেনি কিন্তু কথা বলার ধরণে আন্দজ করতে পেরেছে সে। বাবাকে বলার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেও পরে আর সাহস হয়নি। মনকে অনেক শক্ত করে বুঝিয়েছে যাতে সোহানের নামটা আর কখনও উচ্চারন করা না লাগে। তবে জান্নাতের যে সোহানকে মনে পরে না এমনটা নয়, ভালোবাসে তো সে সোহানকে। যত খারাপই হোক না কেন কালিমা পরে বিয়ে তো হয়েছে তার। যতদিন ডিভোর্স না হয় ততদিন তো মনে পরবেই। মুখে বলা যতই সোজা কিন্তু ভোলাটা এত সোজা না। 

সন্ধ্যার পরে জান্নাতের চাচাতো ভাই জাকির এসে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করে বলল, ভিতরে আসতে পারি? 
জাকির ভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনে জান্নাতের ঠোঁটের কোণে এক রাশ পদ্মফুলের ন্যায় হাসি ফুটে উঠল।
- আসসালামু আলাইকুম জাকির ভাই যে। কেমন আছেন?
- ওয়ালাইকুম আসসালাম জান্নাত। আলহামদুলিল্লাহ। তুই  কেমন আছিস?
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এনে বলল, আছি ভালোই।
- এভাবে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি ভেতরে আসতে বলবি।
- স্যরি ভাইয়া। ভিতরে আসেন। 
- চাচির মুখে সবটা শুনলাম মাত্রই। খুব খারাপ লাগছে তোর জন্য। আমি তো শুরু থেকেই বলেছিলাম এত বড়লোক ঘরে বিয়ে না দেওয়ার জন্য কিন্তু আমার কথা কেউ শুনলো না। মাঝখান থেকে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিল। মানুষের উপরের রুপ দেখে কাউকে অনুমান করা যায় না সে কেমন! চেহারা তো মাসআল্লাহ নায়কের মতো কিন্তু চরিত্র এতটা থার্ডক্লাস কেন? সোহানের মা বাবা কিছু বলেনি? কী আর বলবে নিজের ছেলে বলে কথা। ছিঃ মানুষ যে এতটা জানোয়ার হতে পারে সোহানকে না দেখলে বুঝতামই না। তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোর বাবা আত্নীয়ের ভেতরে সমন্ধ করবে না তাই দূরে করেছে। ছেলে হিসাবে আমি কী একেবারে খারাপ ছিলাম? তোর নাকি ডিভোর্স হবে শুনলাম? যদি এমন কিছু হয় তাইলে তোকে আমি এখনো বিয়ে করতে রাজি আছি। 
- বাদ দেন ভাই। এখন বলেন আপনার চাকরীর কী খবর? 
- আলহামদুলিল্লাহ। সরকারী চাকরী বলে কথা আজ এখানে কালকে ওখানে। 
- হুম। প্রমোশন হয়েছে নাকি! মিষ্টি কই! 
- সবার দোয়ায় প্রমোশন হল। মিষ্টি তো অবশ্যই খাওয়াব। কালকে বিকালে তোকে নিয়ে ঘুরতে বের হব তখন তোকে ট্রিট দিব। আচ্ছা জান্নাত আমি যে তোকে বিয়ে করার কথা বললাম তুই তো কোন রেসপন্স করলি না কোন সমস্যা!
- কী রেসপন্স করব ভাইয়া। আপনি যে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন সেটা তো আমি জানি। আমার বাবা যেখানে দিয়েছে সেখানেই গিয়েছি। কপালে সুখ হয়নি সেটাতে তো কারও হাত নেই। সারাজীবন দুঃখ লেখা ছিল তাই দুঃখেই কাটবে। 
- কিন্তু জান্নাত সোহানকে এভাবে ছেড়ে দিলি? তোর এত বড় সর্বনাশ করল আর তুই নিরবে চলে আসলি। এটা কী হয় বল? 
- বাদ দেন ভাই। শুধু শুধু ঝামেলা করতে চাই না। 

আড়াল থেকে জাহিদুল সাহেব দুজনের আলাপ শুনতে পেল। তিনি এসেছিলেন জাকিরের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তবে ভালোই হল নিজের জীবনের করা একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জান্নাতের জীবনটা নরকে পরিণত হল। 

সখিনা বেগম চা নিয়ে রুমে এসে তার স্বামীকে এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। চায়ের ট্রেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
- কী ব্যাপার আপনি এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কী কথা শুনছেন?
- দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জাহিদুল সাহেব বললেন, লুকিয়ে শোনার কারণে আজকে অনেক বড় একটা সত্যি কথা শুনতে পেলাম না হলে সারাজীবন সত্যিটা অজানাই রয়ে যেত। 
- কী সত্যি কথা?
- তুমি ওদেরকে চা দাও আমি যাচ্ছি। রাতে একা একা তোমাকে সব বলব। 

স্বামীর এমন কথায় সখিনা বেগমের বুকটা ধুক করে উঠে। তারপরও চায়ের ট্রেটা নিয়ে ওদের সামনে যায়। 
মাকে দেখে দুজনে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।

চলবে..............