গল্প: মায়াবিনী
গল্প: মায়াবিনী

#গল্প: মায়াবিনী
#অপূর্ব রাস্তা দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি সুপ্তির রুমের দিকে।ব্যালকনির দরজা বন্ধ।রাস্তায় তেমন লোকজন নাই।চারদিন নিস্তব্ধ। আকাশ ভর্তি তারা।জলমল আলো ছড়িয়েছে আপন মনে।আকাশের মনে হয়তো আজ অনেক সুখ বিরাজ করেছে।কিন্তু কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে অপূর্বের।সুপ্তির সাথে একটিবার কথা বলার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেছে অপূর্ব।অপূর্বের চোখে আজ জল।বুকে ব্যথা।কেন জানি তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।এর কারন কি?জানা নেই অপূর্বের।তবে এর আগে কারো জন্য এমন হয়নি।এর নামেই হয়তো ভালোবাসা।অপূর্বের শরীর খুবই দুর্বল লাগছে।দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।কিন্তু এখান থেকে যেতেও মন চাচ্ছে না।
অপূর্বের খুব ইচ্ছে করছে একবার বাউন্ডারি টপকে সুপ্তির রুমে চলে যেতে।কিন্তু এই শরীরে পারবে কিনা বুঝা যাচ্ছে না।কিন্তু হার মানতেও সে নারাজ।সো যেমন ভাবা তেমন কাজ।অপূর্ব দেয়াল টপকে অনেক কষ্টে চলে যায় সুপ্তির ব্যালকনিতে।রুমের দরজা বন্ধ।অপূর্বের খুব কষ্ট লাগছিল।এই টুকুতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।এর আগে কতোবার এই ব্যালকনিতে এসেছে।কিন্তু এতোটা কষ্ট লাগে নি কখনও।আজ মনে হচ্ছে আর একটুর জন্যে তার প্রাণটা বের হয় নি।অপূর্ব কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে দরজায় আস্তে করে ঠুকা দিয়ে বলে,,,,
-সুপ্তি দরজা খুলো,,!!!সুপ্তি বিছানায় শোয়ে কান্না করছিল।সেও অস্থির হয়ে উঠেছিল অপূর্বের জন্য।এই দুদিনে অপূর্বের কোনো খোঁজ পায় নি।অনেক চেষ্টা করেছিল অপূর্বের সাথে যোগাযোগ করার জন্য।কিন্তু সেটা কিছুতেই হয়ে উঠে নি।অপূর্বকেও আসতে না দেখে সুপ্তি ভেবে নিয়েছিল অপূর্ব হয়তো আর কখনও ফিরে আসবে না।হয়তো অপূর্ব তাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করবে।নিজেকে অনেক কিছু দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সুপ্তি।কয়েকবার মনে মনে চিন্তা করেছে,,,,
'আমার সাথে অপূর্বের যোগাযোগ হলে ভাইয়াতো অপূর্বকে জানে মেরে ফেলবে।ভালোই করেছে অপূর্ব নিজের থেকে আমার জীবন থেকে চলে গিয়ে।হয়তো অপূর্বকে সে পাবে না।কিন্তু ইচ্ছে হলে দূর থেকে তো একবার দেখতে পারবে।না হোক কথা।তবুও সুপ্তি চায় অপূর্ব ভালো থাকুক।সুখে থাকুক।আবার একেকবার মনে আসে,,এই ছিল অপূর্বের ভালোবাসা?কথা ছিল একে অপরকে কোনোদিন ছাড়বে না।আজ এভাবে ভুলে গেলো?তাহলে কি সে ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে?নানান এলোমেলো চিন্তা সুপ্তিকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে।সুপ্তির যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার সময় হয়েছে সুপ্তির।সুপ্তির এই দুইটা দিন যেন দু'শো বছরের মতো লাগলো।
এতো খারাপ সময় তার জীবনে কখনও আসবে ভাবে নি সুপ্তি।সুপ্তি বিছানায় শুয়ে নিঃশব্দে কান্না করছিল।হঠাৎ অপূর্বের কণ্ঠ কানে আসতেই সুপ্তি লাফ দিয়ে উঠে বসে।বুঝতে পারছে না সত্যি অপূর্ব এসেছে নাকি সে কল্পনা করছে বলে এমন শোনাচ্ছে। সুপ্তি স্থির হয়ে বিছানায় বসে।কিন্তু না,আরো দু তিনবার অপূর্বের কণ্ঠ শোনতে পায় সে।সুপ্তি খেয়াল করেছে,কণ্ঠটা ব্যালকনি থেকে আসছে।সুপ্তি আর কিছু চিন্তা না করে দৌঁড়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে দেখে অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে।
অপূর্বকে দেখে সুপ্তি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না।এক লাফে অপূর্বের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে।এক সাগর অশ্রু তার চোখ দিয়ে বের হচ্ছে।কষ্ট গুলো চোখের পানি হয়ে বের হয়ে আসছে।অপূর্ব সুপ্তিকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এতোটা শক্ত করেই ধরে যে মনে হচ্ছে এখন সুপ্তিকে ছেড়ে দিলেই কেউ সুপ্তিকে তার জীবন থেকে নিয়ে যাবে।সুপ্তিকে নিজের বুকে নিতে পেরে অপূর্ব পরম শান্তি ফিল করছে।এই কয়দিনের কষ্টের অবসান ঘটতে শুরু করে।সুপ্তি অপূর্বকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করলো।অপূর্ব সুপ্তিকে কাঁদতে বাঁধা দিলো না।অনেক কষ্ট জমা হয়েছে মেয়েটার মনে।কাঁদুক একটু।
কাঁদলে মন হালকা হবে।সে ছেলে হয়েও যদি কান্না করতে পারে তাহলে সুপ্তি মেয়ে হয়ে কেন পারবে না?এক সময় সুপ্তির কান্নাটা নিজে থেকেই থেমে গেলো।অপূর্ব হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলে করতেই সুপ্তি অপূর্বের বুক থেকে মাথা তুলে অপূর্বের দিকে তাকায়।এই দু'দিনেই অপূর্বকে রোগা দেখাচ্ছে।চোখে মুখে সতেজতার চাপ একদমেই নেই।অপূর্ব সুপ্তির গালে হাত রেখে সুপ্তির কপালে একটা চুমু খায়।তারপর বলে,,,,,
-আমি খুব শীঘ্র তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।তোমার বাবা ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।তাদের বুঝাবো।তুমি চিন্তা করো না।অপূর্বের কথা শোনে সুপ্তির বুকে ধুম করে উঠে।হৃদপিণ্ডটা ঝড়ের বেগে দৌঁড়াতে শুরু করে।শুভ্রর কথা গুলো কানে এসে লাগতে থাকে।'আবার যদি তোকে এই ছেলের কথা বলতে শোনি বা তোদের এক সাথে দেখি,তাহলে আমি ওকে জানে মেরে দিবো'।সুপ্তি তার ভাইকে খুব ভালো করেই চিনে।যদি সত্যি আবার অপূর্বকে তার সাথে দেখে তাহলে অপূর্বকে রক্ষা করা মুশকিল। সুপ্তি কিছুতেই চায় না তার জন্য অপূর্বের কোনো ক্ষতি হোক।অপূর্বকে না পাওয়ার কষ্টটা সুপ্তি মেনে নিতে পারলেও,অপূর্বকে মরতে দেখতে সুপ্তি কিছুতেই পারবে না।অপূর্ব নিজে থেকে যে সুপ্তির জীবন থেকে দূরে যাবে না এটা সুপ্তি ভালোই বুঝতে পেরেছে।সুপ্তি অপূর্বকে নিজের থেকে একটু দূরে ঢেলে দিয়ে বলে,,,,
-তুমি আমাকে ভুলে যাও অপূর্ব।আমাদের এই সম্পর্ক আমার পরিবার কোনো দিন মেনে নিবে না।সুপ্তির দূরে সরিয়ে দেওয়াটা যেন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটা বিষয় ছিল অপূর্বের কাছে।অপূর্ব অবাক হয়ে সুপ্তির কথা গুলো শোনলো।তারপর বললো,,,,
-তোমার পরিবারের সবাইকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার।তুমি আমার উপর ভরসা রাখো।
-তুমি আমার ভাইয়াকে চিনো না অপূর্ব।ভাইয়া একবার যা সিদ্ধান্ত নেয় তাই করে।অযথা আমার জন্য তোমার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।তারচেয়ে ভালো হয় তুমি আমাকে ভুলে যাও।সুপ্তির কথা শোনে অপূর্ব সুপ্তির দিকে একটু এগিয়ে এসে বলে,,,,
-তুমি পারবে আমাকে ভুলে থাকতে?তোমার কষ্ট হবে না?ভুলে যেতে পারবে আমাদের এক সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো?অপূর্বের প্রত্যেকটা কথা যেন সুচের মতো সুপ্তির বুকে গিয়ে লাগছিল।সুপ্তির কলিজাটা ক্ষতবিক্ষত বয়ে গেলো মুহূর্তেই।সুপ্তি জানে,এই জীবনে অপূর্বকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না।মৃত্যুই একমাত্র দুটি হৃদয় আলাদা করতে পারবে।কিছুতেই কান্নাটা আটকাতে পারছে না সুপ্তি।কিন্তু এই মুহূর্তে কান্না করা যাবে না।কান্না করলেই দুর্বলতা কাজ করবে।সুপ্তি ঢোঁক গিলে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখে অপূর্বের চুল এলোমেলো হয়ে আছে।শার্টটাও ঠিক নেই।সুপ্তি একটু এগিয়ে গিয়ে অপূর্বের শার্টের কলার ঠিক করলো।অপূর্বের মাথায় আঙ্গুল চালিয়ে চুল গুলো চিরুনি করে দিলে।তারপর বললো,,,,
-এমন এলোমেলো দেখতে তোমাকে ভালো লাগে না।সব সময় ফর্মাল থাকবা।ফর্মাল থাকলে তোমাকে খুবই ভদ্র আর ইনোসেন্ট লাগে।মা বাবার কথা মতো চলবে।ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করবে।দেখো,তোমার জীবনটা ফুলের মতো সাজানো গুছানো আর সুন্দর হবে।কথা গুলো বলতে সুপ্তির এতো কষ্ট লাগছিল যে বলার মতো না।তবুও সুপ্তি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।নিজের স্বার্থের জন্য কিছুতেই অপূর্বকে বিপদে ফেলতে পারবে না।
সে যে অপূর্বকে খুব ভালোবাসে।নিজের থেকেও বেশি।অপূর্ব যদি সুস্থ থাকে,বেঁচে থাকে তাহলে একনজর দেখতে তো পারবে।এতেও ভালোবাসা কম কোথায়।ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোভাবে একপলক দেখাতেও এক রকম তৃপ্তি পাওয়া যায়।অপূর্ব সুপ্তির কথায় আর কাণ্ডে অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।অপূর্ব ভাবতেই পারছে না সুপ্তি এতোটা শান্ত হয়ে কথা গুলো কি করে বলছে?সে কি জানে না,তাকে ছাড়া অপূর্বকে কল্পনা করা সম্ভব হবে না?সে কি ভুলে গেছে?তার ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থেকেও সে এক রকম মরা।অপূর্ব সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,,
-আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না?থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?অপূর্বের কাঁধে মাথা রেখে সুপ্তি যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নোনা জল বের হয়ে আসলো।সেই জলটা অপূর্বের কাঁধে পড়তে দিলো না সুপ্তি।তার আগেই মুছে ফেললো।সুপ্তি নিজেকে অপূর্বের বুকে বিলিন করে দিলো।এই জায়গায় পৃথিবীর সেরা সুখ বিরাজ করছে।আজকের পর আর এই বুকের সুখ সন্ধান করা হবে না।এখানে আর মাথা রাখা হবে না।আজকেই হয়তো শেষ।কিছুক্ষণ পর সুপ্তি অপূর্বের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলে,,,,
-কেন থাকতে পারবো না?আগে কেমনে থাকতাম?এখন সেভাবেই থাকবো।যে সময়টা এক সাথে কাটিয়েছি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবো।তুমিও ভুলে যাবে।আমাকে ক্ষমা করো।বলে যেই সুপ্তি নিজের রুমের দিকে পা বাড়াবে এমনি অপূর্ব সুপ্তির সামনে হাঁটু ভেঙ্গে বসে সুপ্তির পা দুটি জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।অপূর্ব বলে,,,,,,
-বিশ্বাস করো,তুমিহীনা এই জীবন বৃথা তোমাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।আমি বাঁচবো না সুপ্তি।আমি মরে যাবো।আমাকে এতোটা আঘাত করো না।আমাকে একটু সময় দাও।আমি সব ঠিক করে দিবো।তোমার ভাইকে আমি রাজি করাবো।আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।সুপ্তি জানে,,,এখানে থাকলে কিছুতেই নিজেকে অপূর্বের থেকে দূরে সরাতে পারবে না।অপূর্বের কান্না তার সহ্য হয় না।অপূর্বের সুখের জন্যই তো এতো ত্যাগ।এখন যদি একটু কষ্ট পেয়ে সারা জীবন অপূর্ব সুখে থাকে তাহলে এতে সুপ্তির জীবন ধন্য।সুপ্তি অপূর্বের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।